ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে যত বিখ্যাত নেতা নেত্রী এসেছেন, তাদের মধ্যে প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ অন্যতম। গতকাল ৬ই আগস্ট দিল্লির এইমসে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ৬৭ বছর বয়সী সুষমা স্বরাজ দীর্ঘদিন ধরেই নানা অসুখে ভুগছিলেন। এমনকি অসুস্থতার জন্য এবার তিনি লোকসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণও করেননি। গতকাল সন্ধ্যায় তিনি প্রধানমন্ত্রীর উদ্দ্যেশ্যে কাশ্মীর নিয়ে একটি টুইটও করেন। কিন্তু তারপর হঠাৎই হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাঁকে সঙ্গে সঙ্গেই দিল্লির এইমসে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানেই রাত ১১.১৫ নাগাদ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। দেখে নেওয়া যাক সুষমা স্বরাজের জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশ একনজরে।
সুষমা স্বরাজের জন্ম হয়েছিল ১৯৫২ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি হরিয়ানার আম্বালা ক্যান্টনমেন্টে। তাঁর বাবা ছিলেন হারেদে শর্মা ও এবং মা শ্রীমতী লক্ষ্মী দেবী। তার বাবা ছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বায়ত্ত্বক সংঘের একজন বিশিষ্ট সদস্য। তাঁর বাবা- মা এসেছিলেন পাকিস্তান থেকে। সুষমা স্বরাজ হরিয়ানার অম্বালা ক্যান্টনমেন্টেরই সনাতন ধর্ম থেকে পড়াশোনা করেন এবং সংস্কৃত ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সাম্মানিক সহ স্নাতক পাশ করেন।
রাজনৈতিক জীবনঃ দিল্লির প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী, সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি, সাতবারের সাংসদ, তিনবারের বিধায়ক, লোকসভার বিরোধী দলনেত্রী, প্রাক্তন ভারতীয় বিদেশমন্ত্রী, সুষমা স্বরাজ ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে এক উজ্জ্বল তারা। ১৯৭০ সালে বিজেপির ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদে যোগদানের মাধ্যমে রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় তাঁর। এরপর ১৯৭৫ সালে জর্জ ফার্নান্ডেজের লিগ্যাল ডিফেন্স টিমের সদস্য হন তিনি। জয়প্রকাশ নারায়ণের টোটাল রেভোলিউশনে তিনি সরাসরি যোগদান করেন আর সেখান থেকেই বিজেপির সর্বভারতীয় নেত্রী হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ হয়। ১৯৭৭ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে হরিয়ানার অম্বালা ক্যান্টনমেন্ট বিধানসভা আসনে জিতে তিনি প্রথম বার বিধায়ক হন। ৩ বার তিনি হরিয়ানার বিধানসভার বিধায়ক ছিলেন। ১৯৭৭ সালেই হরিয়ানা সরকারের ক্যাবিনেট মন্ত্রী হন তিনি। আর তারপর মাত্র ২৭ বছর বয়সেই হরিয়ানা বিজেপির রাজ্য সভাপতি।
সক্রিয় রাজনীতিতে কয়েক বছর কাটিয়ে ১৯৯৮ সালে তিনি দিল্লির প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। কিন্তু সেই বছরের ডিসেম্বরেই তিনি পদত্যাগ করেন। ১৯৯০ সালে তিনি প্রথমবার রাজ্যসভার সাংসদ হন, এবং ১৯৯৬ সালে প্রথমবার লোকসভার। অটল বিহারী বাজপেয়ীর ১৩ দিনের সরকারে তিনি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বও পালন করেছিলেন। ১৯৯৮ সালে তিনি পুনরায় নির্বাচিত হন লোকসভায় সাউথ দিল্লি আসন থেকে, এবিং এবারে তিনি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের পাশাপাশি টেলিকমিউনিকেশন মন্ত্রকেরও দায়িত্ব পান। ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব সামলান। তিনি ২০০৩ থেকে ২০০৪ এর সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত সময়ে তিনি কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রী ও সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। এই কার্যকালে তিনি ছয়টি এইমস গঠন করেন।
কিন্তু ২০০৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি হেরে যাওয়ার ফলে তাঁর কেন্দ্রীয় মন্ত্রীত্বও চলে যায়। ২০০৬ সালে তিনি মধ্যপ্রদেশ থেকে রাজ্যসভার সাংসদ হয়ে আসেন এবং ২০০৯ পর্যন্ত রাজ্যসভার বিরোধী দলনেত্রী হিসেবে কাজ করেন। ২০০৯ সালে তিনি বিদিশা কেন্দ্র থেকে পুনরায় লোকসভায় নির্বাচিত হন এবং এবারে তিনি লোকসভায় প্রধান বিরোধী দলনেত্রীর ভুমিকা পালন করেন। ২০১৪ সালে বিজেপি একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসলে তিনি হন মোদী সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী বা বিদেশ মন্ত্রী। ইন্দিরা গান্ধীর পর দ্বিতীয় ভারতীয় মহিলা যিনি ওই পদে আসীন হন। কিন্তু ২০১৯ নির্বাচনে তিনি আর লড়েননি শারীরিক অসুস্থতার জন্যে।
মার্কিন দৈনিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল কর্তৃক সুষমা স্বরাজ’কে ভারতের ‘সর্বাধিক প্রিয় রাজনীতিবিদ’ বলা হয়েছে। বিজেপি নেত্রী, কিন্তু বিপক্ষ সমস্ত দলের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন সম্মান, এমনই ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব। তাঁর লাবণ্য, সকলের সাথে সুব্যবহার, মিষ্টি কথন রাজনীতিতে ব্যতিক্রমীই ছিল। বিধান সভা হোক বা সংসদ, কতবার যে তার বক্তৃতা সকলে সম্মোহিত হয়ে শুনেছে তা গুণে বলা সম্ভব নয়। সুষমা স্বরাজের মৃত্যু আসলে ভারতীয় রাজনীতিতে একটা শুন্যস্থান, ভারতীয় রাজনীতির একটা বিশেষ অধ্যায়ের সমাপ্তি।