অফবিটআন্তর্জাতিকদেশনিউজ

বাংলা ভাষা আন্দোলন ও তার ইতিহাস!…

Advertisement

বাংলাদেশের (Bangladesh) নাগরিক তথা সমগ্র বাঙালি জাতীর কাছে ২১ ফেব্রুয়ারি (February) একটি গৌরবোজ্জ্বল দিন। বাংলাদেশে এই দিনটি ‘শহীদ দিবস’ হিসাবেও পালিত হয়। তবে বিশ্ব জুড়ে যত বাঙালি আছেন, তাঁদের সকলের কাছেই ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি ‘মাতৃভাষা দিবস’ (Mother Language Day) হিসাবে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

বাঙালির মাতৃভাষাকে জাতীয় তথা রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে পরাধীন বাংলাদেশে হাজার হাজার ছাত্র পুলিশের গুলি উপেক্ষা করে আন্দোলনে সামিল হয়। আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পাকিস্তানী পুলিশের নিষ্ঠুর গুলিবর্ষণে শহীদ হন বেশ কয়েকজন ছাত্র। এই দিনটি তাই বাঙালিদের কাছে শহীদ দিবস’ও বটে।

২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭-তে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ‘বাংলা ভাষা প্রচলন বিল’ পাশ হয়। বিলটি অবশ্য কার্যকর হয় সে বছরের ৮ মার্চ থেকে। ১৭ নভেম্বর, ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তবে শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারতের নানা প্রান্তেইবিভিন্ন সময় মাতৃভাষার সম্মানজনক স্বীকৃতি ও সমানাধিকারের দাবিতে বার বার গর্জে উঠেছে বাঙালি। চলুন জেনে নেওয়া যাক সেই স্বল্প পরিচিত বাংলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস…

ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বাংলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে মানভূম ও অসমের নাম প্রথম উঠে আসে। কবে মানভূম, অসম ছাড়াও ঝাড়খন্ড, বিহার, ছত্রিশগড়, কর্ণাটক ও দিল্লিতেও বাঙালিরা একজোট হয়েছেন তাঁদের মাতৃভাষার সম্মানজনক স্বীকৃতি ও সমানাধিকারের দাবিতে।

ব্রিটিশ শাসিত ভারতে ১৯১২ সালে মানভূম জেলাকে বিহার ও ওড়িশার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। সে সময় মানভূমবাসী বাংলার সঙ্গে তাঁদের জেলাকে যুক্ত করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। এর সঙ্গেই যুক্ত হয় মানভূমে বাংলা ভাষায় কথা বলার দাবিও। ১৯৫৬ সালে সরকারি ভাবে নতুন জেলা গঠনের মাধ্যমে ওই আন্দোলনের দাবি পূরণ হয়।

উনিশ শতকের শেষ ভাগে মুসলিম নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা শুরু করেন এবং তখন থেকেই আধুনিক ভাষা হিসেবে হিসেবে বাংলার বিস্তার বিকশিত হয়। ভারতের পূর্বাঞ্চলে বাংলা ভাষার সমর্থকরা ভারত ভাগের আগেই উর্দুর বিরোধিতা শুরু করেন। ১৯৩৭ সালে মুসলিম লিগের লক্ষ্মৌ অধিবেশনে বাংলার সদস্যরা উর্দুকে ভারতের মুসলিমদের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা মনোনয়নের প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেন।

এরপর আসা যাক অসমের বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রসঙ্গে। যখন অসম সরকার অসমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন সেখানকার বাঙলা ভাষা-ভাষীর অসংখ্য মানুষ। বলে রাখা ভাল, সে সময় বরাক উপত্যকায় বাংলাভাষীরাই ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। ১৯ মে, ১৯৬১ সালে ১১ জন বাঙালি প্রতিবাদীকে শিলচরের পুলিশ হত্যা করে। শিলচরের বাঙালিরা শহীদদের মৃতদেহ নিয়ে প্রতিবাদে রাস্তায় নামেন। এই ঘটনার পর অসম সরকার বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষাকে সরকারী ভাষার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।

দেশ ভাগের পর পূর্ব বাংলার হিন্দু উদ্বাস্তুদের ‘দণ্ডকারণ্য’ প্রকল্পের মাধ্যমে ১৩২টি গ্রামে পুনর্বাসন দেওয়া হয়, এর মধ্যে ৩৩টি গ্রামই পখাঞ্জুরে অবস্থিত। কিন্তু, ‘দণ্ডকারণ্য’ প্রকল্প বন্ধ হলে ছত্রিশগড় সরকার পরে বাংলায় শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়। বাংলা মাধ্যমের বিদ্যালয়গুলিকে হিন্দি মাধ্যমে রূপান্তরিত করা হয়।

নিখিল ভারত বাঙালি উদ্বাস্তু সমিতির নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু করেন বাংলা ভাষা-ভাষীর হাজার হাজার মানুষ। বিদ্যালয়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে পঠনপাঠন এবং সরকারি কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহারের দাবিতে আন্দোলন চলতে থাকে। ছত্রিশগড়ের পখাঞ্জুর থেকে শুরু করে রাজধানী দিল্লিতে তাঁরা বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। সাময়িক কিছু সমস্যার সমাধান হলেও এখনও বেশ কিছু দাবিতে আন্দোলন আজও চলছে।

১৯৫৬ সালের আগে পুরুলিয়া বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বিহারের স্কুল-কলেজ-সরকারি দপ্তরে হিন্দি ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসাবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। সেই সময় পুরুলিয়া আদালতের আইনজীবী রজনীকান্ত সরকার, শরৎচন্দ্র সেন এবং গুণেন্দ্রনাথ রায় জাতীয় কংগ্রেস ছেড়ে জাতীয়তাবাদী আঞ্চলিক দল লোক সেবক সঙ্ঘ গড়ে তোলেন। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে তাঁরা আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত এই আন্দোলনের তীব্র প্রভাব পড়ে স্থানীয় বাঙালিদের উপর।

Related Articles

Back to top button