এসেছে শরৎ হিমের পরশ লেগেছে হাওয়ার পরে
সকাল বেলায় ঘাসের আগায় শিশিরের রেখা ধরে
কবি লিখেছিলেন এই কবিতা, আকাশের পেঁজা মেঘ, মাঠে-ঘাটে কাশফুলের দোলা, কখনো হালকা বৃষ্টি কখনো রোদ ঝলমলে আকাশ আমাদেরকে বোঝায় মা আসছেন। তার সন্তান সন্ততি কে নিয়ে মা আসছেন। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপূজা। সারাবছরের আমাদের কলুর ঘানিরমত জীবন টানতে টানতে আমরা ক্লান্ত হয়ে যাই। সেই ক্লান্তি আমরা জিরোই পুজোর চারটি দিন। আড্ডা আনন্দে মেতে উঠি আমরা। কখনো বাড়ির লোকের সঙ্গে কখনো আবার বন্ধুদের সঙ্গে। আলোচনা হয় পুজোয় নতুন গান, পুজোয় নতুন কবিতা, নতুন উপন্যাস, কিংবা পুজোর নতুন সাজগোজ নিয়ে। কিন্তু এই দুর্গাপূজার উৎস কোথায়? আমরা মহালয়ার টিভিতে, অনুষ্ঠানে যে দুর্গাপুজোর ঘটনাটি দেখে থাকি, এটি একেবারেই পৌরাণিক। চলুন দেখে নিই মহিষাসুরমর্দিনী এর ইতিহাস।
বঙ্গদেশের শক্তিপূজার অন্যতম বিশেষ প্রকাশ শারদীয় দূর্গোৎসবের ঐতিহ্য বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কিছু জানা অত্যন্ত জরুরী। প্রতিবছর আশ্বিন কার্তিক মাসে বঙ্গ দেশের সর্বত্র দশভূজা মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা দেবীর মূর্তি কয়েকদিন ধরে পুজো করে, বিজয় দশমী বিসর্জন দেওয়া হয়। এর সম্পর্কে তেমন কিছু বলা যায় না। বঙ্গদেশ এবং অন্যত্র আদি মধ্যযুগ থেকে আরম্ভ করে উত্তর মধ্যযুগ পর্যন্ত সকল প্রকার ধাতুনির্মিত মহিষমর্দিনী মূর্তি পাওয়া গেছে। তাদের সচরাচর মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধরত অবস্থায় দশপ্রহরনধারিনী তিনি দেবীকে এবং দেবীর বাহন সিংহের কাটা মাথা থেকে নির্গত নররূপী অসুরকে দেখানো হয়ে থাকে।
বাংলা শারদীয়া দূর্গা প্রতিমা লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ কে অতিরিক্ত পরিবার দেবতারূপে দেখানো হয়। কোন প্রাচীন প্রস্তর নির্মিত মূর্তি আজ আবিষ্কৃত হয়নি। কিন্তু এটা মনে রাখতে হয় যে শারদীয়া দূর্গা প্রতিমা প্রতিবছর পূজা করা, পূর্ব পূর্ব বছরের কাঠামোর ওপর নতুন করে নির্মাণ করায় সুতরাং এর উপরেই প্রতিমা কাঠামো নির্মাণে কত প্রাচীন, তার প্রত্নতত্ত্ব প্রমাণ সংগ্রহ করা অসম্ভব। এই বিষয়ে ঐতিহাসিকগণ কে সাহিত্যগত তথ্যের উপর নির্ভর করতে হয়।
তথ্য লিখিত আছে যে সুরত রাজা ও সমাধি বৈশ্য ঋষি মেধসের নিকট থেকে মহামায়া দুর্গা তথ্য জেনে নদীতীরে গমন করেন এবং সেখানে অবস্থান পুর্বক জগন্মাতার দর্শন লাভ কামনা করে, শ্রেষ্ঠ জপ করেন। এই নদীর ধারে দেবীর প্রতিমা নির্মাণ করে ফুল দিয়ে পূজা করেন। রাজা ও বৈশ্য তিন বছরে পুজো করেন। তবে দেবীর দর্শন পেয়েছিলেন। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ থেকে জানা যায় যে পুজো শেষে তারা মৃন্ময়ী প্রতিমা বিসর্জন দিয়েছিলেন। সুরত রাজা যে সময় দুর্গাপূজা করেছিলেন সেটি ছিল বসন্তকাল। বসন্তকালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল আজও অনুরূপে বসন্তকালে বাসন্তী দেবীর পূজা বাংলাদেশে প্রচলিত আছে। শরৎকালের দেবীর পূজা ব্যাপকভাবে হয় তার অন্যতম প্রথম উল্লেখ আমরা পাই কালিকাপুরাণ এ।
যেহেতু পূর্বে শরৎকালের দেবগন কর্তৃক মহাদেবী বোধিত হয়েছিলেন। সেই কারণে পীঠস্থান এবং লোক মধ্যে তিনি শারদা নামে বিখ্যাত হন । এখানে দেবগনের শরৎকালের বোধনের কথা হয়েছে। কৃত্তিবাস কর্তৃক রামচন্দ্র অকালে বোধন হয়নি। তবে বাংলায় দুর্গাপূজার অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে কৃত্তিবাসী রামায়ণ। কালিকাপুরাণ বাংলাদেশে রচিত হয়েছিল এর রচনাকাল কৃত্তিবাসের আগে। এতে শারদীয়া পূজার কথা বলা হয়েছে কিন্তু দেবতাদিগকে এই পূজার প্রথম প্রবর্তক বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
খ্রিস্টীয় চতুর্দশ পঞ্চদশ শতকের বিখ্যাত বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতি তাহার দুর্গা ভক্তি তরঙ্গিনী নামক গ্রন্থে দেবীর উল্লেখ করেছেন। একই সময়ে বর্তমান ছিলেন দুর্গোৎসব বিবেক,বাসন্তী বিবেক এবং দুর্গোৎসব প্রয়োগ নামক তিনটি নিবন্ধ এ তার পূর্ববর্তী নিবন্ধ কার দুজনেরই সম্পর্কে উক্তি করেছেন।তারা দুজনেই বাঙালি ছিলেন। তাদের আবির্ভাব কাল সম্পর্কে সঠিক কিছু জানা না গেলেও এটা বলা যায় যে তারা বাংলার অন্যতম প্রাচীন স্মৃতি নিবন্ধকার ভব দেব ভট্টের পূর্ববর্তী ছিলেন। তিনি তার নিবন্ধটি মৃন্ময়ী প্রতিমায় দেবীর পূজার্চনা বাংলাদেশ সহস্র বছর ধরে প্রচলিত আছে। এমন তথ্যই দেয় তবে দেবী তার পরিবার দিকের রূপায়নে যে সুদীর্ঘকালের মধ্যে কোন পরিবর্তন আনা হয়নি তা বলা যায় না লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ যেভাবে কিছুদিন আগে পর্যন্ত দেবীর পরিবারের দেবতারূপে প্রদর্শিত হতো। এখন কোন কোন প্রাচীন প্রতিমাতে প্রদর্শিত হয়। এটা ঠিক কোন সময় প্রথম প্রচলিত হয় সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না।
তবে বোঝাই যাচ্ছে যে দুর্গাপুজো বা মহিষমর্দিনী পূজা অনেকটাই প্রাচীন ইতিহাসের পাতা উল্টালে বা প্রত্নতত্ত্বের কিছু উপাদান সংগ্রহ করে তা ধুলো ঝেড়ে দেখতে পারি।
Written By – শ্রেয়া চ্যাটার্জি