রেলের টিকিট বুকিং ব্যবস্থা বরাবরই সাধারণ যাত্রীদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং প্রক্রিয়া। বিশেষ করে, যখন তৎকাল টিকিটের প্রশ্ন আসে, তখন এই চ্যালেঞ্জ আরও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অথচ দালালদের হাতে কনফার্ম টিকিট সবসময়ই থাকে। সাধারণ মানুষ যেখানে দীর্ঘ ওয়েটিং লিস্ট দেখে আশাহত হন, সেখানে দালালরা কীভাবে নিশ্চিত টিকিট জোগাড় করে? এটি যেন এক রহস্যময় কৌশল যা বহু যাত্রীর কাছে আজও অজানা। আসুন, এই অন্ধকার জগতের দরজা খুলে দেখি কীভাবে দালালরা টিকিট বুকিং ইকোসিস্টেমের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে।
দালালরা প্রথমেই বাল্ক বুকিংয়ের কৌশল গ্রহণ করে। তারা একই রুটে ও ভিন্ন ভিন্ন তারিখে একসঙ্গে বহু টিকিট বুক করে রাখে। কারণ, রেলের প্রতিটি রুট এবং শ্রেণির জন্য নির্দিষ্ট কোটায় টিকিট বরাদ্দ থাকে। এই পদ্ধতি দালালদের হাতে কমপক্ষে কয়েকটি নিশ্চিত টিকিট থাকার নিশ্চয়তা দেয়। অনেক সময় তারা টিকিট বুকিংয়ের একাধিক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে, যা তাদের আরও বেশি টিকিটের মালিক হতে সাহায্য করে।
তবে, দালালদের সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র হল তৎকাল বুকিং। তৎকাল টিকিট সাধারণত ভ্রমণের তারিখের এক দিন আগে খোলা হয়, যা যাত্রীদের শেষ মুহূর্তের ভরসা। দালালরা এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অত্যাধুনিক সফটওয়্যার এবং স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি ব্যবহার করে চোখের পলকে টিকিট বুক করে ফেলে। তারা একাধিক এজেন্ট বা অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে বুকিং প্রক্রিয়াকে এমনভাবে পরিচালনা করে যাতে সাধারণ মানুষ পেছনে পড়ে যায়। যদিও এই ধরণের স্বয়ংক্রিয় সফটওয়্যার ব্যবহার করা রেলের নিয়মের পরিপন্থী, তবুও দালালরা এই উপায়ে নিজেরা সুবিধা আদায় করে।
দালালদের আরেকটি বড় অস্ত্র হল ওয়েটিং লিস্টের কৌশলী ব্যবহার। তারা ওয়েটিং লিস্টের ওঠানামা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে এবং বাতিল হওয়া টিকিট দ্রুত সংগ্রহ করে। আবার অনেক সময় যাত্রীদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে শেষ মুহূর্তে টিকিট সরবরাহ করে। এটি দালালদের হাতে থাকা টিকিটের সরবরাহ চক্রকে শক্তিশালী করে তোলে।
তবে এই গোটা ব্যবস্থায় সবচেয়ে বিতর্কিত দিকটি হল টিকিটের আইডি যাচাই পদ্ধতি। দালালরা কাউন্টার থেকে টিকিট বুক করে এবং যাত্রীকে বলে যে তাদের নাম ছাড়া আর কিছু লাগবে না। কারণ, কাউন্টার থেকে নেওয়া টিকিটের জন্য আইডি দেখানোর বাধ্যবাধকতা নেই। অনেক সময়, এই ধরণের টিকিটে যাত্রীদের আসন নিশ্চিত হয় না এবং তারা ঝুঁকির মুখে পড়ে। ভাগ্য ভালো হলে সমস্যা এড়ানো যায়, কিন্তু ভাগ্য খারাপ হলে জরিমানা গুনতে হয় এবং নতুন করে টিকিট কাটতে হয়। ফলে যাত্রীর খরচ বেড়ে যায় এবং ভোগান্তির শেষ থাকে না।
এই পুরো চক্রটি পরিচালিত হয় একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্কের মাধ্যমে, যেখানে দালালরা বুকিং সিস্টেমের অভ্যন্তরীণ কিছু কর্মীর সঙ্গেও যোগাযোগ রাখে। তারা রেলের কিছু দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে নিজেরা সুবিধা পায় এবং সাধারণ যাত্রীদের থেকে দ্বিগুণ বা তিনগুণ টাকা হাতিয়ে নেয়।
সুতরাং, টিকিট বুকিং ইকোসিস্টেমে দালালদের এই আধিপত্য শুধু যাত্রীদের জন্য নয়, গোটা রেল ব্যবস্থার জন্যই একটি হুমকি। সাধারণ মানুষের জন্য ন্যায্য এবং সহজলভ্য টিকিট বুকিং ব্যবস্থার নিশ্চয়তা দেওয়া প্রয়োজন। অথচ বাস্তবে, দালালদের এই চক্র ভাঙতে এখনও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ প্রতারিত হচ্ছে এবং দালালদের হাতে বন্দি হয়ে পড়ছে।
এই চক্র থেকে মুক্তি পেতে হলে যাত্রীদের সচেতন হওয়ার পাশাপাশি, রেলের পক্ষ থেকেও শক্তিশালী প্রযুক্তিগত এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। তবেই একদিন এই অন্ধকার ব্যবসা বন্ধ হবে, আর সাধারণ মানুষ ন্যায্য মূল্যে নির্ভয়ে টিকিট কাটতে পারবে।