কিং কোবরার সঙ্গে লড়াই করে বাঁচিয়েছেন হাজারো ভারতীয়র প্রাণ, চিনে নিন এই ব্যক্তিকে
কিছুদিন আগেই একটি ভয়ঙ্কর কিং কোবরার কামড় থেকে বেঁচে ফিরেছেন ভাভা সুরেশ
কেরলে যদি কোনদিন কোন সাপের উপদ্রব হয় তাহলে সবার আগে খবর দেওয়া হয় সাপ ধরার রাজা ভাভা সুরেশকে। কিন্তু সেই সাপের কামড়েই একদিন সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাকে। গত ৩১শে জানুয়ারি কেরালার কোট্টায়ম অঞ্চলে একটি বিষাক্ত কাল কেউটে সাপ ধরার প্রচেষ্টা করেছিলেন ভাভা সুরেশ। কিন্তু তখনই হঠাৎ করে তার ডান দিকের পায়ে ছোবল মারে ওই সাপ। তবে তিনি একেবারে ভয় পেয়ে যান নি। বরং তিনি সাপের সঙ্গে লড়াই করে প্রথমে ওই সাপ উদ্ধার করেন এবং তারপরে ওই সাপটিকে বনদপ্তরের হাতে তুলে দিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। প্রথমদিকে ভেন্টিলেটর সাপোর্টে রাখা হলেও, বর্তমানে সম্পূর্ণরূপে সুস্থ ভাভা সুরেশ। তার জন্য অতিরিক্ত চিকিৎসার খরচ বহন করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল কেরালা সরকার। কেরালা স্বাস্থ্যমন্ত্রী বীণা জর্জ তার জন্য আলাদাভাবে আর্থিক সাহায্য দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন।
তবে, এই প্রথম নয়। এর আগেও বিভিন্ন জায়গায় নিজের সাপ ধরার কৌশলের জন্য সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে। তবে এবারে সরাসরি কোবরা সাপের দংশনে রীতিমতো গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন ভাভা সুরেশ। ৩১ শে জানুয়ারির ওই ঘটনার পরেই তাকে স্থানীয় সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল চিকিৎসার জন্য। রাজ্যের মন্ত্রী ভি এন ভাসাভান নিজে তদারকি করে ভাভা সুরেশ এর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। এমনকি এর মধ্যেই একদিন সুরেশকে দেখতে হাসপাতালে পর্যন্ত গিয়েছিলেন মন্ত্রী।
অবশেষে, সেই ভয়ঙ্কর সময়টা কাটিয়ে হাসি খুশি মেজাজে বাড়ি ফিরলেন ভাভা সুরেশ। তিনি জানালেন, এর আগেও তাকে ১৬ বার সাপের কামড় সহ্য করতে হয়েছিল। তবে কোনো বারই পরিস্থিতি এতটা বাড়াবাড়ি হয়নি। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসারত ডাক্তারদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন সুরেশ। তিনি বলছেন, “আমার জীবন রক্ষার জন্য হাসপাতালে সকলেই দারুন ভাবে সাহায্য করেছেন। পাশাপাশি জনগণের প্রার্থনা আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে এনেছে। আমি মনে করছি এটা আমার দ্বিতীয় জীবন।”
এর আগে মেডিকেল টিম এ তরফ থেকে বলা হয়েছিল, সুরেশের শরীর সম্পূর্ণরূপে বিষমুক্ত হয়ে গিয়েছে। সুরেশের জীবন রক্ষার জন্য প্রায় ৫০ বোতলের কাছাকাছি অ্যান্টিভেনম ড্রাগ ব্যবহার করা হয়েছে হাসপাতালে। স্বাভাবিকের থেকে প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ ব্যবহার করতে হয়েছিল এই ওষুধ। ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি ভেন্টিলেশন সাপোর্টে ছিলেন। আপাতত সুরেশের কোন জ্বর নেই। এই কারণেই তাকে বাড়িতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে মেডিকেল বোর্ড। তবে সাপের দংশন এর কারণে সৃষ্ট ডান পায়ের ওই ক্ষতটি এখনো সম্পূর্ণরূপে সারেনি। তবে হ্যাঁ, শরীরে সামান্য ব্যথা থাকলেও আস্তে আস্তে সুরেশ সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে যাবেন বলে ধারণা ডাক্তারদের।
সুরেশ যখন জন্মগ্রহণ করেছিলেন তখন তার পরিবার ছিল অত্যন্ত গরীব। কেরলের তিরুবনন্তপুরম জেলার শ্রীকার্জম টাউনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তবে প্রথম থেকেই সরীসৃপ নিয়ে তার বেশ আগ্রহ ছিল, আর সেই আগ্রহ আরও তীব্র হয় যখন মাত্র ১২ বছর বয়সে সে নিজের চোখের সামনে একটি কোবরা সাপ দেখতে পায়। তখন আশির দশকের মাঝামাঝি সময়। একদিন স্কুল থেকে বাড়ি আসতে আসতে হঠাৎ করেই তার সামনে চলে আসে একটি দীর্ঘ সাপ। তবে কোনোভাবেই সেই সাপের থেকে ভয় পায়নি সুরেশ। বরং নিজের জলের বোতলে ওই ভয়ঙ্কর কোবরা সাপটাকে ধরে বাড়িতে নিয়ে এসে দিন পনেরোর জন্য পুষেছিল ওই ছোট্ট বালকটি। একটা সময় তার সঙ্গে ওই সাপের একটা বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল।
সেই থেকে শুরু। তারপরে নিজের ৪৭ বছরের জীবনে একের পর এক সাপ ধরে কেরলের বাসিন্দাদের সুরক্ষার্থে কাজ করে এসেছেন ভাভা সুরেশ। বর্তমানে ৩০ বছর ধরে তিনি জনগণের সেবা করছেন এবং এই মুহূর্তে কেরলের বনদপ্তরে বেশ উচ্চপদে তিনি কর্মরত রয়েছেন। স্কুলের পড়াশোনা শেষ না করেই এই সাপ ধরার কৌশল শিখে নিয়ে কাজ করতে শুরু করেছিলেন সুরেশ। এখনো পর্যন্ত তিনি ৩০,০০০ এর বেশি সাপ ধরেছে নিজের হাতে, যার মধ্যে ২০০টি ছিল অত্যন্ত ভয়ঙ্কর বিষধর কিং কোবরা। এই ধরনের সাপ এর ক্ষেত্রে সাধারণত অ্যান্টিভেনম ওষুধগুলি কাজ করে না। তাই এই ধরনের সাপ ধরা কোন মুখের কথা নয়।
ইউটিউবেও বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন সুরেশ। সারা রাজ্য জুড়ে তার ভিডিওগুলি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। সঙ্গেই, তার হাত দিয়ে সাপ ধরার কৌশল অনেক সময় সমালোচনাও ডেকে নিয়ে আসে। ভাভা সুরেশ সব সময় সরীসৃপদের নিজের বন্ধুর মত মনে করেন। বিশেষ করে সাপ তার অত্যন্ত কাছের একটি প্রাণী। এই কারণে কোনো হুক অথবা কোন লোহার সামগ্রী ব্যবহার করেন না তিনি সাপ ধরার সময়। যদিও, লোহার সামগ্রী ব্যবহার না করার বিষয়টি অত্যন্ত বিপদজনক কিন্তু তবুও, এই কৌশলেই তাকে এতদিন পর্যন্ত সাপ ধরতে দেখা গিয়েছে। মালয়ালাম ভাষায় তিনি একটি ইউটিউব চ্যানেলও খুলেছেন, যার নাম তিনি দিয়েছেন স্নেক মাস্টার। তবে শুধুমাত্র সাপ ধরাই নয়, সারা ভারতে সর্প সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও উদ্যোগী ভূমিকা নেন ভাভা সুরেশ।
তিনি সর্বদা মনে করেন, যখন সাপের বাসস্থান এবং খাদ্য কমে যেতে শুরু করে, ঠিক তখনই সাপ মানুষের প্রতি হিংস্র হয়ে ওঠে। কিছুটা ক্ষেত্রে মানুষের দোষও রয়েছে। তাই তিনি সকলকে অনুরোধ করেন যেন কোনোভাবেই তারা সাপের প্রতি ক্রুরতা না প্রদর্শন করেন এবং তাদেরকে নিজের বাসস্থানে সঠিক ভাবে বসবাস করার সুযোগ করে দেন। তার সর্প সংরক্ষণের কৌশলের মাধ্যমে তিনি ইতিমধ্যেই ২০,০০০ এর বেশি সাপের ডিম থেকে বাচ্চা তৈরি করেছেন, এবং সুরেশের বাড়ি বর্তমানে একটি সর্প সংরক্ষণশালার থেকে কম কিছু নয়। তার মতো মানুষেরা রয়েছেন বলেই এখনো পর্যন্ত পৃথিবীটা কংক্রিটের জঙ্গল হয়ে যায়নি।