শ্রেয়া চ্যাটার্জি – আমাদের দেশ ভারতবর্ষ সর্বদাই উর্বরভূমি। না, কোনরকম অহংকারবশে কথাটা নয়। অর্থলোভে, শিক্ষার লোভে, এদেশ থেকে মানুষজন বিদেশে পাড়ি দেয়, একথা ঠিক। কিন্তু ভারতবর্ষে রয়েছে সোনার খনি। যে দেশে জন্মেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্কিম, জীবনানন্দ দাস, জগদীশচন্দ্র বোস, প্রফুল্ল চন্দ্র রায় সেই দেশ তো ঈশ্বরের সমান। আমরা নিজেদের দেশকে সম্মান করি না। এই দেশে পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে চলে যাই বিদেশে।
ঠিক তেমনটাই হয়েছিল এই বিজ্ঞানীর ক্ষেত্রে। একসময় বাঁচিয়েছেন লক্ষেরও বেশি মানুষকে। কিন্তু কপালে সম্মান জোটেনি। যদিও এনাদের মতন মানুষ সম্মানের আশাও করতেন না। শুধু নীরবে কাজ করে যেতেন। সময়টা ছিল ১৯৫০ সাল, যখন ডক্টর শম্ভুনাথ দে একজন কলকাতা থেকে পাশ করা বৈজ্ঞানিক তিনি ক্রমাগত খুঁজে চলেছেন কলেরার টক্সিন। ইনি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে দেখলেন যে কলেরার একটি সাধারণ কারণ হলো ডিহাইড্রেশন অর্থাৎ শরীরের জল কমে যাওয়া। এই কলেরার টক্সিন তৎক্ষণাৎ শরীরে জলের চাহিদা মেটাবে। ভারতের জন্য তার অবদান অপরিসীম কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ভারত তাকে সম্মানিত করেনি কোনদিনই। তবে আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্র তার এই অবদান কে আমরা বারবার সাদরে গ্রহণ করেছি।
কলকাতা থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে গাড়ি-বাড়ি গ্রামে ১৫ এপ্রিল ১৯১৫ সালে তার জন্ম। বাবা ছিলেন একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। স্কলারশিপ পাওয়ার পরই তিনি ক্যালকাটা মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করেন ১৯৩৫ সালে। তারপরে তিনি লন্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলেরায় মৃত্যু হয়েছিল ইউরোপের লক্ষাধিক মানুষের। কলকাতায় তিনি বোস ইনস্টিটিউশনের হয়ে কাজ করেছিলেন। ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত তিনি তৈরি করেছিলেন কলেরার টক্সিন। তিনি যোগদান করেছিলেন নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে রবার্ট কচ এক সময় এক কথা লিখেছিলেন ‘কলেরা নিয়ে যারা গবেষণা করছেন তাদের দেশে কলেরা নেই বললেই চলে। অথচ ভারতের মতো দেশে যেখানে প্রচুর কলেরা রোগী, সেখানে কলেরা নিয়ে গবেষণা তেমন কেউই করেন না।’
যেখানে সবাই মনে করতেন কলেরার ফলে অন্ত্রের দেওয়ালের উপরে যে পিচ্ছিল পদার্থ দ্বারা আবৃত আবরণী আছে তা নষ্ট করে কলেরা জীবানুর সবখানে ছড়িয়ে পড়া , একটা গৌণ উপসর্গ। শম্ভুনাথ দেখালেন এটি আসলে জীবাণু সংক্রমণ প্রভাব। তার মতে, বিষটি এনডোটক্সিন নয়, এক্সোটক্সিন। বছরের পর বছর চলতে থাকা ধারণাটি শম্ভুনাথ পাল্টে দিয়েছিলেন।
১৯৭৩ সালে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক চাকরি জীবন থেকে অবসর নেন। কাজের উপযুক্ত স্বীকৃতি না পাওয়া, গবেষণা ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না পাওয়া, সব মিলিয়ে তিনি হতাশ ছিলেন ভীষণভাবে । অবশেষে ১৯৭৮ সালে নোবেল ফাউন্ডেশন তাকে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালে তিনি মানসিকভাবে কিছুটা শক্তি ফিরে পান। এরপরে তিনি পুনরায় গবেষণায় মন্দার অবশিষ্ট জীবন তিনি গবেষণাতেই নিজেকে উৎসর্গ করেন। তবে জীবনের স্বীকৃতি না পেয়ে অবহেলায় গবেষণার কাজ ঠিকমতো চালাতে না পেলেও তিনি কিন্তু দমে যাননি। তিনি তার কাজ করে গেছেন। ১৯৮৫ সালের ১৫ এপ্রিল অধ্যাপক শম্ভুনাথ দে মৃত্যুবরণ করেন ছিল।