শ্রেয়া চ্যাটার্জি – চিড়িয়াখানায় গিয়ে খাঁচায় বন্দি পশু গুলোকে দেখে আমরা বেশ হেসেছি, একটা সময় আনন্দ করেছি। কিন্তু আজকে আমাদের অবস্থাটা একটু ভাবুন। গোটা বিশ্বের মানবজাতি আজ গৃহবন্দী। প্রকৃতির উপর মানুষ একদিন এতটাই অত্যাচার করেছে প্রকৃতি আজ বুঝি তার সাজা দিচ্ছে মানুষকে। প্রকৃতির কোলে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে জীবজন্তু। আর হবে নাই বা কেন, সেখানে যে মানুষ নেই মানুষের তৈরি কোন যানবাহন নেই, যানবাহন থেকে বেরোনো কোন কালো ধোঁয়া নেই। আছে শুধুই মুক্ত বাতাস, মুক্ত আলো, মুক্ত আকাশ।
পশুপাখিরা হয়তো মনে মনে গাইছে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়। কয়েকদিনের লকডাউনে সারাবিশ্বব্যাপী দূষণের মাত্রা কমেছে বেশ। প্রকৃতি শ্বাস নিচ্ছে প্রাণভরে। কিন্তু মানুষ আজ কোন পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে! পাপই তো। পরিবেশকে দিনের-পর-দিন মানুষ করেছে কলুষিত। তা কি দিনের পর দিন প্রকৃতির সহ্য করতে পারে? তাই বুঝি এমন প্রতিশোধ। আমরা যদি এরপরেও না বুঝি সত্যি কিছু করার নেই, তাহলে মৃত্যু অবধারিত।
গোটা পৃথিবীর চিত্র টা একটু পাল্টে গেছে। মানুষ ঘরের মধ্যে বন্দি। বিশ্বের উপর থাবা বসিয়েছে মারণ করোনা ভাইরাস। কিন্তু রাস্তায় দেখা যাচ্ছে কিছু অতিথিদের। যারা হয়তো এতদিন বন্দি ছিল কিংবা মানুষের আনাগোনায় বা পায়ের ধ্বনিতে ভয় পেয়ে তারা অনেকটা দূরে ছিল, এখন ফাঁকা জায়গায় নিরিবিলিতে তারা দিব্যি রয়েছে। জাপানের নারা পার্ক সংলগ্ন এলাকার ফাঁকা রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে এক পাল হরিণকে। আপনি কোন সিনেমা দেখছেন না। সত্যি হয়েছে। রাস্তা দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক পাল হরিণ, দেখলে আপনার চোখটা জুড়িয়ে যাবে। কিন্তু আপনার নিজের চোখে দেখার উপায় নেই, কারণ আপনি আজ গৃহবন্দি। দেখতে হবে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে।
শুধু বিদেশেই নয় কয়েকদিন আগে মুম্বাইয়ের সমুদ্রে দেখা গিয়েছিল ডলফিন কে। সমুদ্রের ধারের কোলাহল আজ নেই, তাই এমন ঠাণ্ডা পরিবেশে ডলফিনরা বেশ মজাই করেছে। কিছুদিন আগে সোশ্যাল মিডিয়া আর একটি ছবিও বেশ ভাইরাল হয়। বিদেশের কোন এক মিউজিয়ামে ঘুরে বেড়াচ্ছে পেঙ্গুইনের দল। ঠিক যেন মনে হবে আপনি গিয়ে পড়েছেন আন্টার্টিকায়। এমনভাবে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে যেন পুরো জায়গাটাই তাদের একেবারে কেনা। দর্শক মুক্ত শুনশান জায়গায় দিব্যি কাটাচ্ছে তারা। ক্যালিফোর্নিয়ার পশ্চিম অকল্যান্ডের বন্ধ স্কুলের মাঠেও ধরা পড়েছে এক অদ্ভুত ঘটনা। স্কুলের মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে বন্য টার্কির দল।
তাহলেই বুঝুন, আপনি এদের উপর কতটা অত্যাচার করেছেন। যে এরা এতদিন বন্দি জীবন কাটিয়েছে। মিউজিয়ামে, চিড়িয়াখানায় সবাই পশুপাখি দেখতে যায়। আমরাও আমাদের আনন্দের কয়েকটা মুহূর্ত কাটাতে চাই এদের সঙ্গে। কিন্তু আমরাও একটা জিনিস মাথায় রাখি না এরা বন্যপ্রাণী, বনের শান্ত নিরিবিলি পরিবেশেই থাকতে বেশি ভালোবাসে। আমরা আমাদের আনন্দ করতে গিয়ে এদের শান্তি এতটাই নস্ট করে দিচ্ছি, যাতে এরা পৃথিবীতে ঠিকঠাক ভাবে থাকতে পারছে না। আজকে যেই মুহূর্তে মানুষ একটু গৃহবন্দি হয়েছে, ব্যাস এরাও শুরু করে দিয়েছে নিজের মতো করে স্বাধীনভাবে পৃথিবীতে বাঁচতে।
করোনাভাইরাস প্রাণ কেড়ে নিয়েছে অনেক মানুষের। তা সত্যিই দুঃখজনক। কিন্তু এটি আমাদের শিক্ষা দিয়েছে অনেক। উন্নতির শিখরে ক্রমশ ছুটতে থাকা মানুষ শিখেছে ঘরের মধ্যে সময় কাটাতে, একে অপরকে ক্রমাগত দোষ দিতে চলা মানুষ আজ ঝগড়া বিবাদ এড়িয়ে চলছে, ঘরের শিশুরা বাবা-মাকে একসঙ্গে পাচ্ছে, পরিবেশের দূষণ কমেছে, প্রকৃতি এবং প্রাণিকুল শ্বাস নিচ্ছে প্রাণভরে। বেশি বেশি করে খাওয়া মানুষটাও আজ মেপে খাচ্ছে। সামাজিক এবং পরিবেশগত ভাবে আমরা উপকৃত হয়েছি। তবে আবারও একটা কথাই বলা, পরিবর্তনটা হয়তো এতটা ভয়ঙ্কর ভাবে না এলেও হত।