‘শিব ঠাকুরের গলায় দোলে বৈচি ফলের মালিকা’।
শ্রেয়া চ্যাটার্জি – ছোটবেলার মা বলতেন শিবের মাথায় জল ঢালো, শিবের মতন বর হবে। শিবকে সত্যি কোন মেয়ে কি বর হিসাবে চায় ! তা ঠিক জানা নেই, তবে দেবতা গণ এর মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছেন শিব। আজ আমাদের গন্তব্য তারকেশ্বর, কিন্তু তারকেশ্বরে যাওয়ার আগে তারকেশ্বরের উপবিষ্ট দেবতা সম্পর্কে চলুন একটু জেনে নি।
প্রাচীন কালে সিন্ধু সভ্যতার একটি মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল, সেটা ছিল একটি সুঠাম পুরুষ মূর্তি যার চারিদিকে পশু দ্বারা আবৃত। ঐতিহাসিক ব্যাসাম একে ‘পশুপতি শিব’ বলেছেন। তবে অনেকে আবার একে ‘পশুপতি শিব’ বলতে নারাজ কারণ তাদের মতে, এই মূর্তিটি চারপাশে প্রচুর বন্য পশু দ্বারা আবৃত ছিল, তাদের মতে শিব হলেন গৃহস্থালির দেবতা তাই এটি কখনোই পশুপতি শিব নয়। এছাড়াও সিন্ধু সভ্যতার উৎখনন থেকে প্রচুর পরিমাণে লিঙ্গ পাওয়া গেছে, যেটা থেকে মনে করা যেতেই পারে, এই লিঙ্গের পুজা বহু আগে থেকেই মানুষের মধ্যে প্রচলন ছিল। পরবর্তীকালে ঋক বেদে বৈদিক সাহিত্যে সত্যম শিবম সুন্দরাম কথাটি পাওয়া যায়। অথর্ববেদ এই শিবের সাতটি মুখ্য নাম পাওয়া যায়। পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী, পতঞ্জলির মহাভাষ্য শিবের নাম পাওয়া গিয়েছিল। বিভিন্ন রকমের বৌদ্ধ সাহিত্য যেমন দীর্ঘ নিকায়, বেণহুও, ঈশান এর নাম পাওয়া যায়, এর মধ্যে বেণহু হল বিষ্ণুর পালি নাম, অন্যটি হলো শিবের নাম। এ দেবতার পূজা তামিল, তেলেগু, কানাড়ি ভাষাভাষী মানুষ রাও করে থাকেন। কারো কারো মতে শিব নামটি এসেছে রক্তবর্ণ যা তামিল শব্দ শিব্বপ্পু থেকে নির্মিত। চলুন জেনে নিই এই শিবের পুজো হয় তারকেশ্বরে সেখানকার ইতিহাস।
হাওড়া থেকে তারকেশ্বর লোকাল এ করে পৌঁছে যেতে পারেন তারকেশ্বর স্টেশনে ট্রেন ভাড়া ১৫ টাকা। এক ঘন্টা অন্তর অন্তর হাওড়া থেকে ট্রেন পেয়ে যাবেন। চাইলে হাওড়া থেকে বা ধর্মতলা থেকে বাসে যেতে পারেন এবং গাড়িতেও যেতে পারেন তবে ট্রেনের জার্নি অনেক বেশি কমফর্টেবল। স্টেশনে নেমে হাঁটাপথে ১০ মিনিট পেরোলেই পৌঁছে যাবেন বাবার মন্দিরে।
হুগলি জেলার এই মন্দিরের ইতিহাস খুবই প্রাচীন। বিষ্ণুদাস নামে এক ভক্ত অযোধ্যা থেকে হুগলিতে আসেন, বসবাস শুরু করেন। কিন্তু স্থানীয় লোকজন তাকে সন্দেহের চোখে দেখতেন, খানিকটা এক ঘরে হয়ে বসবাস করতেন বিষ্ণুদাস। সাধারণ মানুষ তার এমন অবস্থা করেন যে তাকে বাধ্য করেন পরীক্ষা দিতে, যে তিনি একজন সৎ মানুষ। বিষ্ণু দাসকে শক্ত লোহার একটি দন্ড কে খালি হাতে ধরতে বলা হয়, তিনি তাই করেন এতে তিনি গুরুতর আহত হন। মনে গভীর যন্ত্রণা অনুভব করতে থাকেন। তিনি তার ইষ্ট দেবতা শিব কে মনে মনে ডাকতে লাগলেন। কয়েক দিন পরে বিষ্ণুদাস এর ভ্রাতা জঙ্গলে এক আশ্চর্য জিনিস লক্ষ্য করেন, তিনি দেখেন গরুরা প্রতিদিন জঙ্গলের একটি বিশেষ স্থানে গিয়ে দুধ দিয়ে আসছে। সেখানে গিয়ে তিনি একটি পাথর দেখতে পান, এই সময় বিষ্ণুদাস স্বপ্নাদেশ পান যে ঐখানেই রয়েছে মহাদেবের মূর্তি। ওই স্থানেই পরবর্তীকালে তারকেশ্বরের মন্দির গড়ে ওঠে। বিষ্ণুদাস এর পরে প্রধান সন্ন্যাসী ধুম্রপান মন্দির এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
নারায়ণ সান্যাল এর লেখা রূপমঞ্জরী গ্রন্থে, এই শিবের আবির্ভাব সম্পর্কে আরেকটি ঘটনা পাওয়া যায়, ধরিত্রী মায়ের গর্ভে অবস্থানকালে একবার শিশু ভোলানাথ এর ইচ্ছা হয়েছিল পৃথিবীর স্বরূপ দর্শন করার, তাই তিনি ধরিত্রীর গর্ভ থেকে উঁকি দিয়ে দেখেছিলেন দুঃখে জর্জরিত বিশ্ববাসীকে। এতে তিনি দুঃখ শোকে পাথর হয়ে গেলেন। সেই সময় থেকেই তিনি ওখানে পাথর রূপে অবস্থান করছেন। এই লিঙ্গটিকে বলা হয় সয়ম্ভু লিঙ্গ কারণেই লিঙ্গটিকে কেউ স্থাপন করেন নি। শ্রাবণ মাসে চৈত্র মাসে এবং শিব রাত্রিতে এখানে জন সমাগম বেশি হয়। এছাড়াও প্রতি মাসে রবিবার ও সোমবার এখানে বেশ ভিড় হয়। মন্দিরের সামনে আছে দুধ পুকুর, কথিত আছে এই দুধ পুকুরে স্নান করে বাবা শিবের মাথায় জল ঢাললে আপনি পূণ্য অর্জন করবেন। বাবার মাথায় জল ঢালার সময় ভোর চারটে থেকে দুপুর বারো টা আর বিকেল চারটে থেকে রাত সাড়ে আটটা। আপনি চাইলে বাড়ি থেকে ঘট নিয়ে গিয়ে দুধ পুকুর থেকে জল ঢালতে পারেন শিবের মাথায়, তাছাড়াও ওইখান থেকে কিনে নিয়ে বাবার মাথায় জল ঢালতে পারেন। তবে ওখানকার ঘটের দাম বেশ বেশি হয়। পুজো দেওয়ার পাশাপাশি দুপুরবেলা ভোগ প্রসাদ এর ব্যবস্থা পেয়ে যাবেন এখানে। নির্দিষ্ট মূল্যের কুপন কেটে ভোগ প্রসাদ খাওয়া যায়। এছাড়া মন্দির চত্বরের বাইরেও পেয়ে যাবেন গরম গরম খাবারের বন্দোবস্ত। থাকা ও বিশ্রামের জন্য রয়েছে বিভিন্ন ধরনের লজ। মন্দিরে যাওয়ার রাস্তার দুই ধারে রয়েছে দোকানে। যাওয়ার আগে এখান থেকে কেনাকাটা করতেই পারেন আপনি। যারা দূর থেকে গাড়ি নিয়ে আসবেন তাদের জন্য রয়েছে সুন্দর গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। যদি ভিড় এড়াতে চান তবে এই বিশেষ দিন গুলো বাদ দিয়ে মাঝের দিনগুলোতে ঘুরে আসতে পারেন তারকেশ্বর।