১৯৫২ সালে জলপাইগুড়ি জেলায় জন্ম হয়েছিল তার। বাবা-মায়ের দেওয়া নাম ছিল অলকেশ লাহিড়ী। কিন্তু সেই নামে তিনি কোনদিনই তেমন পরিচিতি পান নি। সখ করে বাপি ডাক নাম রেখেছিলেন তার এক আত্মীয়। কে জানতো একদিন ওই নামেই গোটা বিশ্ব কাঁপাবেন বলিউডের এই সঙ্গীত শিল্পী। বাড়িতে সঙ্গীতের চর্চা প্রথম থেকেই থাকলেও ডিস্কো সঙ্গীতের চর্চা তেমন একটা ছিল না। বাবা অপরেশ লাহিড়ী আর মা বাঁসুরী লাহিড়ী ছিলেন বাংলা সঙ্গীত জগতের পরিচিত নাম। ফলে মা-বাবার থেকেই গানের জগতে হাতে খড়ি। ১৯ বছর বয়সে চোখে স্বপ্ন নিয়ে মুম্বাই পাড়ি দেন বাপি লাহিড়ী। তার ইচ্ছে ছিল মুম্বাইয়ে একদিন তিনি সু-প্রতিষ্ঠিত হবেন। ১৯৭৩ সালে হিন্দি ভাষার সিনেমা নানহা শিকারি ছবিতে প্রথম গান রচনা করলেন বাপি লাহিড়ী। তারপর থেকে একের পর এক সিনেমায় গান রচনা এবং মিউজিক ডিরেক্টর এর কাজ। তাহির হোসেনের জখমি সিনেমায় তার সংগীত বেশ প্রশংসিত হয়েছিল।
শোনা যায় নাকি মাত্র ১১ বছর বয়সে প্রথম গানের সুর দিয়েছিলেন বাপি লাহিড়ী। গানের বিষয় তার পাণ্ডিত্য ছিল অগাধ। তার বাংলা ছবিতে হাতে খড়ি ওগো বধূ সুন্দরী সিনেমার মাধ্যমে। কিন্তু, বলিউড জগৎ তাকে সব সময় টানতো। তাই বাবা মাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি বম্বেতে চলে যান। একজন বাঙ্গালীর হাত ধরেই তা সংগীত জগতে প্রবেশ। ১৯৭৪ সাল, রাহুল দেব বর্মনের হাতে তখন প্রচুর কাজ। তার ডেট পাওয়াটা সত্যি কষ্টকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে প্রযোজকদের কাছে। তাই, অন্য আরেকজন সঙ্গীত পরিচালকের প্রয়োজন। হুসেনের সিনেমা মদহোশে সঙ্গীত পরিচালনা করলেন রাহুল দেব বর্মন। তবে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক তৈরি করার ডাক পেলেন বাপি লাহিড়ী। তখন তিনি একেবারেই আনকোরা বলিউডে। কিন্তু বাপি লাহিড়ী রাজি থাকলেও তার বাবা অপরেশ লাহিড়ী বাধা দিলেন বাপি লাহিড়ীর কাজে।
তার বাবা সরাসরি তাহের হোসেনকে জানিয়ে দিলেন, আর ডি বর্মনের সুর দেওয়া ছবিতে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের কাজ করবেন তার ছেলে, তবে একটা শর্ত রয়েছে। আর ডি বর্মনের কাছ থেকে নো অবজেকশন সার্টিফিকেট নিয়ে আসতে হবে তাহের হোসেনকে। ভবিষ্যতে যাতে এই নিয়ে কোনো রকম কথা না ওঠে, সেই কারণেই তিনি এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সেই ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বেশ জনপ্রিয় হয়। তারপরে কিশোর কুমারের গলায় জালতা হে জিয়া মেরে অথবা লতা মঙ্গেশকরের গলায় আভি আভি থি দুশমনি এর মত গান দিয়ে বলিউডে নিজের নাম তৈরি করে ফেলেন বাপি লাহিড়ী। তবে তার প্রথম সবথেকে জনপ্রিয় ছবি ছিল জখমী। খুব অদ্ভুত ভাবে, সেই ছবির প্রযোজক ছিলেন তাহের হোসেন। ওই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন সুনীল দত্ত, আশা পারেখ, রাকেশ রোশন এবং রীনা রায় সহ আরো অনেকে। পরিচালনায় ছিলেন রাজা ঠাকুর।
তবে সেখান থেকেই তার জীবনের মোড় ঘুরতে শুরু করে। ধীরে ধীরে তার দেওয়া মিউজিক বলিউডে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। তিনি হয়ে ওঠেন ডিস্কো কিং। রোমান্টিক গান থেকে শুরু করে ভজন এবং কাওয়ালী, রাগাশ্রয়ী গান থেকে শুরু করে ডিস্কো সংগীত, সবকিছুতেই তার অনেক যাতায়াত। ৩৩টি ছবির জন্য ১৮০টি গান রেকর্ড করে ১৯৮৬ সালে গিনিস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নিজের নাম তুলেছিলেন বাপি লাহিড়ী। এমনকি জনাথান রসের লাইভ পারফরম্যান্সে আমন্ত্রণ পাওয়া একমাত্র ভারতীয় মিউজিক ডিরেক্টর ছিলেন বাপি লাহিড়ী। ১৯৮৯ সালে তার আইকনিক গান জিমি জিমি আজা আজা গানটি হলিউড ছবি ‘you don’t mess with the zohan’s’ এও ব্যবহার করা হয়। তার অদ্ভুত সাজপোশাকের জন্য তিনি ভারত বিখ্যাত।
কালো চশমার গলায় বেশ কয়েক ভরি সোনার চেন, এরকম ভাবেই বাপি লাহিড়ীকে সব সময় দেখা যেত। কিন্তু কেন এরকম সোনার হার পরে থাকতেন বাপি লাহিড়ী? তিনি নিজেই এই প্রশ্নের উত্তর দেন। তিনি বলেন, তার মা তাকে প্রথমে একবার সোনার চেইন উপহার দিয়েছিলেন। এরপর তার স্ত্রী তাকে গণেশের লকেট দেওয়া একটি চেন উপহার দেন। তিনি মনে করেন সোনা তার জন্য বেশ লাকি। এই কারণেই তিনি সোনা পরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিছুদিন আগে খবর উঠেছিল তিনি নাকি গলার স্বর হারিয়েছেন। তবে সেই সমস্ত খবরকে ধূলিসাৎ করে কিছুদিন আগে একটি রিয়েলিটি শো-তে এসেছিলেন বাপি লাহিড়ী। এই বছর পুজোর সময়ে তার নতুন গান রিলিজ হয়েছে। তখন কে জানতো, পুজোর মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি চিরনিদ্রার দেশে চলে যাবেন। লতা মঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের পর আবারো সংগীত জগতে দুঃসংবাদ। মুম্বাইয়ের একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন বাপি লাহিড়ী। তার গানগুলির মাধ্যমে তিনি ভারতীয়দের মননে চিরকাল থাকবেন সজীব।