শ্রেয়া চ্যাটার্জি – কাজ করতে করতে আর মাথা দিয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়েনা, পাথর ভাঙতে ভাঙতে কাঁধ, হাতের পেশীতে টান ধরেনা, কোন পোয়াতি মা’কে তার বাচ্চা পেটে নিয়ে ইট বইতে হয় না, গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে মেহনতি মানুষগুলি আজ বাড়িতে বসে। স্টেশনে ট্রেন ঢোকে না, তাই কুলিরও প্রয়োজন হয়না, রাস্তাঘাটে কেউ বেরোচ্ছেন না, তাই রিক্সাওয়ালার প্রয়োজন হচ্ছে না, চায়ের দোকানের ঝাঁপ বন্ধ, সকাল বেলা মর্নিংওয়াকের পরে চা খেতে আসা মানুষগুলি আজ বাড়িতেই টুকটাক ব্যায়াম করে শরীরচর্চা করছেন। কলকারখানার ভোঁ বাজেনা। সকলেই ঘরের মধ্যে আটকা পড়ে আছে। অথচ আজ ‘মে দিবস’। অন্যান্য বছর এই মেহনতি মানুষগুলি আজকের দিনে একটা দিন ছুটি পায়, কিন্তু বিগত কয়েকদিন ধরে ছুটিতেই থাকতে থাকতে, আজকের দিনটির গুরুত্বই অনেকেই প্রায় ভুলতে বসেছেন। শুধু ভারতবর্ষ বললে ভুল হয়, গোটা বিশ্বের দৃশ্যটা অনেকটা একই রকম। ভারতবর্ষ যেহেতু গরিব দেশ, তাই এখানে মেহনতি মানুষের চেহারাটা অনেকের সামনে ফুটে ওঠে।
‘মে দিবস’এর গুরুত্ব ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করে লেখা হয়ে রয়েছে। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটের ম্যাসাকার শহীদদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে পালিত হয় এই দিনটি। প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে শ্রমিকরা একত্রিত হয়েছিল হে মার্কেটে।তাদেরকে ঘিরে থাকা পুলিশ তাদের ওপর বোমা বর্ষণ করতে থাকেন। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে আমস্টারডাম শহরে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারিত হয় এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বজুড়ে পয়লা মে তারিখে মিছিল ও শোভাযাত্রা আয়োজন করতে সকল সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল এবং শ্রমিক সংঘের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। ১লা মে তারিখে ‘বাধ্যতামূলকভাবে কাজ না করার সিদ্ধান্ত’ নেওয়া হয়।
কিন্তু করোনা ভাইরাস এর জেরে বর্তমানে গোটা বিশ্বজুড়ে লকডাউন চলছে। কেমন আছে মেহনতি মানুষরা? সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে খাদ্যদ্রব্য। কিন্তু করোনা চলে গেলে, লকডাউন উঠে গেলে কি অবস্থা হবে! তাদের কার কার জীবিকা কতটা থাকবে? বেকারত্ব কি বাড়বে? আজকে মে দিবসের দিনে এই প্রশ্নই সকলের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এক অচেনা, অজানা মে দিবসের সাক্ষী রইলাম আমরা প্রত্যেকে। আজকের দিনে মানুষগুলি একটু ছুটি চেয়েছিল, কিছুটা কম সময় কাজ করতে চেয়েছিল অন্তত ইতিহাস তাই বলে। কিন্তু ২০২০ সালের আজকের মে দিবসে, মানুষ কি সত্যি ছুটি চাইছে? না, এই বন্দি জীবন থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছে। আবার যে যার কাজে ব্যস্ত হতে চাইছে। করোনা যেভাবে আমাদের জীবনে চির ছুটি এনে দিয়েছে, এমন ছুটি আমরা কেউ চাইনি। এমন অভিজ্ঞতা থেকে হয়তো আর কেউ ছুটি চাইবেও না। মেহনতি মানুষগুলি আজ করোনার কাছে বলছে “করোনা তুমি চলে যাও, আমরা কেউ ছুটি চাইনা।”